প্রাক-কথন : জন্মিলে মরতে হবে একথা চিরন্তন সত্য। যিনি হায়াতদাতা তিনিই মৃত্যুদাতা। জন্ম-মৃত্যু একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিপত্তি ঘটে তখন, যখন তা আর স্বাভাবিক থাকে না। পৃথিবীতে আত্মহত্যার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। নানা সময় নানা বয়সের মানুষকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। আত্মহত্যাকারীদের কোনো বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যাবে না। শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবার মধ্যেও আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা যায়। বর্তমান যুগে আত্মহত্যা একটি গুরুতর সমস্যা। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশু, কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আত্মহত্যা মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ । ধর্মীয় দিক থেকে এটি কবীরা গুণাহসমূহের মধ্যে অন্যতম । আত্মহত্যাকারী চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।
আত্মহত্যার কারণ : বেশিরভাগ শিশু-কিশোর ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিতে ভূগে। প্রধানত হতাশা তাদের গ্রাস করে। তরুণ-যুবাদের আত্মহত্যা প্রচেষ্টা প্ররোচিত করে যে বিষয়গুলো তাহলো দুঃখ-গ্লীনি, সন্দেহ-সংশয়, ক্ষোভ-রাগ, অথবা মনোযোগ ও অতি সক্রিয়তার সমস্যা। আর টিনেজারদের সমস্যা হলো মানসিক চাপ, আত্ম-সন্দেহ, সফল হওয়ার চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা, হতাশা এবং ক্ষতি ইত্যাদি। কিছু কিছু কিশোর-কিশোরী তো আত্মহত্যাকেই তাদের সমস্যার সমাধান বলে ভেবে নেয়। তবে দুইজন চলনে বলনে কখনো এক না হলেও আত্মহত্যার ক্ষেত্রে উভয়ের কারণ অভিন্ন । কিছু কিশোর এমনও আছে যারা খেলার সাথী কিংবা বাবা-মায়ের সাথে ঠুনকো দ্বন্দের জের ধরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা প্রচেষ্টার মূলে আছে হতাশা। এছাড়াও যে বিষয়গলো এর জন্য কাজ করে তা হলো:
ক) পরিবারের সদস্যেদের মাঝে এহেন কর্মকাণ্ড ঘটানোর ইতিহাস থাকলে;
খ) নিম্ন আত্মমর্ধাদা বোধে ভুগলে;
গ) সহিংসতার মাঝে বেড়ে উঠলে;
ঘ) আক্রমণাত্মক আচরণ, মতামত প্রকাশ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলে;
ঙ) কেউ তার সেবা-যত্ করে না, মনের মাঝে এই বিশ্বাস জন্ম নিলে;
চ) আগ্নেয়ান্ত্র হাতে আসলে;
ছ) বলাৎকারের শিকার হলে;
জ) নিরাশা ও অসহায়ত্ব বোধ জন্ম নিলে;
ঝ) নিশা-ভাঙ গ্রহণে অভ্যস্থ হলে এবং
চ) মারাকআ্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ও কারো থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি দশজনে নয়জনেরই আত্মহত্যা প্রচেষ্টার পেছনে মানসিক অসুস্থতা ব্যাধি অথবা সম্পদের অপব্যবহার। কোনো ব্যক্তির মাঝে নিমৌক্ত চিহৃগুলো প্রকটিত হলে বুঝতে হবে সে আত্মহত্যা প্রবণতার পথে হাঁটছে। সেগুলো হলো :
ক) ব্যক্তির খাদ্য ও ঘুমের অভ্যাসে অকস্মাৎ পরিবর্তন দেখা দিলে;
খ) ব্যক্তির অহেতুক, অস্বাভাবিক জটিল, উন্মাদ, বা বিদ্রোহী আচরণ প্রকাশ
পেলে;
গ) পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে;
ঘ) যৌন বিদ্বেষ, মিথ্যাচার, এবং ভাঙচুর করলে;
ঙ) ব্যক্তিত্বে কঠোরতা প্রকাশ পেলে;
চ) উত্তেজনা, অস্থিরতা, কষ্ট, বা আতঙ্কিত আচরণ প্রকাশ পেলে;
ছ) আত্মহত্যা সম্পর্কে কথা বললে বা লিখলে, তা নিয়ে মজা করলে,
জ) মুল্যবান সম্পদ নষ্ট করলে এবং
ঝ) স্কুলের কর্মকাণ্ড ক্রমশ খারাপের দিকে গেলে।
ঞ) মৃত্যু ও মৃত্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও কর্মতৎপর হলে বুঝতে হবে এই ব্যক্তি আত্মহত্যা প্রবণতার পথে অগ্রসর।
বন্ধুরা, আত্মহত্যা কি জীবন সমস্যার সমাধান হতে পারে?
আত্মহত্যার ব্যাপরে ইসলামের বিধান কী?
মানুষের জীবনে হতাশা আসে একথা সত্য এবং হতাশার কারণে আমাদের সমাজে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ । জীবন সংকটময় হতে পারে। সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। তাই বলে মৃত্যুই কী হতে পারে সব সমস্যার সমাধান? না, অহেতুক মৃত্যুর কোনো মানে হয় না।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর তোমরা আত্মহত্যা করো না। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তোমার প্রতি দয়াবান”
(আল-কুরআন, ৪:২৯)।
মানুষ যারা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একবার ভেবে দেখা দরকার । আমাদের কি দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে এই জন্যে যে,
হাসি-তামাশার মধ্যদিয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিব?
আমাদের কী দুঃখ-দুর্দশী গ্রাস করতে পারে না?
জীবনে কী সংগ্রাম বলতে কিছু নেই?
কঠিন বাস্তবতা হলো
সকল মানুষই স্বীকার করবে যে, জীবনটা ফুলশয্যা নয়। বরং সকলেই একথা বলবে যে, জীবন মানেই সংগ্রাম। সংগ্রামী দলের সাথে যারা একাত্ম হতে পারে তারাই মূলত বিজয়ী । যদি তুমি ভেবে থাক যে আত্মঘাতী ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জীবন বিনাশ করার মাধ্যমে খেলা সম্পন্ন করবে, তাহলে এটি তোমার ভুল ভাবনা। এ ভাবনা থেকে তোমার ফিরে আসা অপরিহার্য, নতুবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে মারাত্মক পরিণতি ।
ছাবিত ইবনু যাহাক বর্ণনা করেন যে নবী (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পার্থিব জগতে যে বস্ত দ্বারা নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামত দিবসে সে ব্যক্তি ওই জিনিস দ্বারাই শাস্তি ভোগ করবে"।
আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে অনুরূপভাবে লাফ দিতেই থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পান করবে এবং নিজেকে হত্যা করবে সে ব্যক্তি চিরকালের জন্য জাহান্নামের আগুনে বিষে চুমুক দিয়ে মরতে থাকবে। যে ব্যক্তি লৌহ শলাকা দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে তার হাতে সেই লোহা থাকবে, যা তার পেটে জাহান্নামের আগুনে চিরকালের জন্য নিক্ষেপ করবে (ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৭৮)।
আমরা যারা এই সমাজে বসবাস করি তাদের প্রত্যেকের জীবন নানা সমস্যায় জর্জরিত। স্বাভাবিকভাবেই তুমি এ খবর জান না, কারণ প্রত্যেকেই তার সমস্যার কথা চেপে রাখে, শুধু তাদের ভালো দিকগুলোই অন্যের সামনে উপস্থাপন করে ।
জীবনটা একটি পরীক্ষা এবং প্রত্যেকের জন্য জন্য আলাদা আলাদা করে প্রশ্নপত্র ছাপানো আছে। তাই সকলের প্রশ্নপত্র তথা পরীক্ষা বা বিপদের ধরন এক হবে না। এই অবস্থায় তোমার ছবর করা, আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আল্লাহ তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী । তিনি পাথরে বৃক্ষ জন্মাতে পারেন, তিনি মরুভুমিতে বৃষ্টি দিতে পারেন, তিনি রাতের আধাঁর দূর করতে পারেন, তিনি বৃদ্ধ বয়সে যাকারিয়া (আ.)-কে সন্তান দিতে পারেন, তিনি ইউনুস (আ.)-কে তিমির পেট থেকে রক্ষা করতে পারেন, তিনি আইয়ুব (আ.)-কে রোগ হতে মুক্তি দিতে পারেন। যিনি সব পারেন, তিনি কী তোমার বিপদ বা দুঃসহ যন্ত্রনা দূর করতে পারেন না?
আমাদের উচিত সবসময় আল্লাহর প্রতি আশাবাদী থাকা। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না।
মনে রাখবে, ভালো ছাত্রের জন্য সব সময় পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন হয়। এর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ সুক্ষভাবে তাকে যাচাই করে নেয়। কারণ আগামী দিনের দেশ ও দশের কান্ডারী ভাবা হয় তাকে। তার উপযুক্ত পুরস্কারও সমাজ তাকে দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার বান্দাকে এমন একটি কণ্টকের (বিপদ) জন্য পুরস্কৃত করেন যা সে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সহ্য করে। সদা মনে রাখবে, জান্নাত লাভ করা এতটা সহজ নয়। এটি চিরস্থায়ী
সুখের জায়গা । তুমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করা ব্যতিরেকে জান্নাতের নেয়ামত ভোগ করার প্রত্যাশী করতে পার না।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “মানুষ কি মনে করে যে আমরা তাদের বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়ে বলব এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা অতীতে মানুষকে পরীক্ষা করেছি যাতে সত্যবাদীরা পরিচিত হয় এবং মিথ্যাবাদীরা পরিচিত হয় কুরআন ২৯ : ২-৩)”।
তিনি আরো বলেন, “নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে এবং ধন-সম্পদ, জীবন আর ফল-ফসলের হাস ঘটিয়ে। সুসংবাদ তাদের জন্য যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী (কুরআন ২: ১৫৫-১৫৬)”।
জীবন চলার পথে নানা সমস্যা উকি দিবে সত্য। তাই বলে এর সমাধান হতে পারে না জীবন সংহার করা, বরং ধৈর্য ধারণ করা এবং সরাসরি আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। প্রয়োজনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। ইসলামে আত্মহত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও ঘৃণার কাজ। এই ধরনের ব্যক্তি মৃত্য পরবর্তী জীবনে অবিরাম শাস্তি পাবে যেভাবে সে আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যাপ্রবণতা থেকে ফেরানোর দুটি উপায় উপায় হতে পারে।
১) সমস্যা উদ্বাটন করা : যে তরুণ আত্মহত্যার কথা ভাবে সে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা বা কথা বলাও বন্ধ করে দিতে পারে। সে তার নিজের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগ্তলো বিলিয়ে দিতে আরম্ভ করতে পারে। এ সময় বাবা-মা অথবা অন্য কারো যদি মনে হয় যে, উমুক ছেলে বা মেয়ের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে। তাহলে তার উচিত ওই ছেলে বা মেয়ের সাথে মিশে গিয়ে তার গোপন কষ্ট সম্পর্কে জানা ও তার কষ্ট লাঘব করা৷ তাকে এই ধরনের প্রশ্ন করা যেতে পারে। তাহলো : তুমি কি দুঃখি বা হতাশাগ্রস্ত বোধ করছ? কেন? তুমি কি নিজেকে কষ্ট
দেওয়া বা আত্মহত্যা করার কথা ভাবছ? কেন? তুমি কি নিজেকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছ? কেন?
২) ব্যক্তিকে কর্মে ব্যস্ত রাখা : আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার জন্য নিন্মোক্ত কাজগুলোর সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন।
ক) আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস তৈরি করা;
খ) সব ধরনের বিপদে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেওয়া;
গ) বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যাসী করা;
ঘ) মার্জিত ও রুচিশীল ও ইসলামী সাহিত্য পাঠ এবং আবৃত্তি ও ইসলামী সংগীত শ্রবণ করানো;
উ) সৎসঙ্গী, শিক্ষক, মুরুব্বিদের সাথে বেশি বেশি মিলামিশী করানো ও
চ) অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণ করানোর ব্যবস্থা করা।
হে বন্ধু, তোমার জীবন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দেওয়া একটি আমানত। তুমি দুনিয়ার জীবনকে একটি পরীক্ষা স্বরূপ মনে করো । যদি তুমি এই পরীক্ষায় পাস কর, তাহলে আল্লাহ্ তাআলা পরকালে পুরস্কার স্বরূপ এমন এক স্থান দান করবেন যেখানে তুমি অনন্তকাল সুখে জীবনযাপন করবে। সঙ্কটময় সময়ে ধৈর্যধারণ করতে হবে, হাল ছাড়া যাবে না। বিপদ ও হতাশার সময় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয-স্বজন, শিক্ষক ও পরিবারের ঘনিষ্টজনের সাথে তোমার কষ্টের কথা ভাগাভাগি করবে যারা তোমাকে ভালবাসে । নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমে সুন্দর একটা সমাধানের পথ বের করে দিবেন।
লেখকঃ আব্দুল মুক্কীত বিন খোয়াজ উদ্দীন।
বাংলাদেশ।