মহাসমুদ্র মানেই রহস্য আর রোমাঞ্চে ঘেরা। পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭১ ভাগ জুড়ে থাকা এই বিশাল রহস্যময় রাজ্যের বহু প্রাণিকুল, অনেক খাত, অঞ্চল অনেক কিছুই আমাদের এখনও অজানা। জরিপ বলছে, সমুদ্র তলদেশের ৯৯ শতাংশই মানুষের এখনও অজানা!
জায়ান্ট স্কুইড: Giant squid
এই প্রাণীটি অনেকেরই চেনা। জায়ান্ট স্কুইড আসলে জলজ্যান্ত কিংবদন্তি। বহুকাল একে জ্যান্ত দেখার জন্য বহুজন হন্যে হয়ে খুঁজেছে। প্রথম আবিষ্কারের পর থেকে দেড়শ বছর মানুষ বহু চেষ্টা চালিয়েছে এই দানবের জলজ্যান্ত ছবি নেওয়ার জন্য। কিন্তু গভীর সমুদ্রে এই দানবের দেখা অত সহজে মেলেনি। ২০০৪ সালে জাপানের একটি রিসার্চ টিম এই দানবের জ্যান্ত অবস্থায় এবং প্রকৃতিতে পাওয়া সর্বপ্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হয়। ২০১২ সালে জাপানেই এদের সর্বপ্রথম ভিডিও ধারণ করা হয়। আটটা বাহু আর দুইটা বিশাল টেন্টাকল শুঁড়ের এই দানবের এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দৈর্ঘ স্ত্রীর ১৩ মিটার বা ৪৩ ফুট আর পুরুষের ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট। এদের চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী যা হাড়গোরকেও নিমিষে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
Giant squid https://www.istockphoto.com/ |
ডাম্বো অক্টোপাস: Dumbo Octopus
এ প্রাণীটি কিন্তু মোটেও ভয়ঙ্কর না। এদের দুইপাশে কানের
মতো পাখনা রয়েছে। আর সে থেকেই এমন নাম। এ পর্যন্ত এদের ১৩টি প্রজাতি আবিষ্কৃত
হয়েছে। এরা সবাই গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা। এরা সাগরের মিডনাইট জোনে (সমুদ্রপৃষ্ঠ
হতে ১৩০০০ ফুট গভীরে) বসবাস করে, যেখানে আলো ঠিকমতো পৌঁছায় না। এরা
এমন তুলতুলে শরীর নিয়ে পানির এমন গভীর চাপে কীভাবে টিকে আছে সেটাও বড় রহস্য।
গবলিন হাঙর: Goblin shark
সমুদ্রের ১৩০০ মিটার (৪২৬৫ ফুট) গভীরের বাসিন্দা গবলিন সার্ক। এদের দেখলে ভিনগ্রহের প্রাণী বলেই মনে হবে। কারণ এদের মুখের গঠন! পাশাপাশি গবলিন সার্ককে জ্যান্ত ফসিলও বলা চলে। হাঙরের এই অদ্ভুত দর্শন প্রজাতিটিকে জ্যান্ত ফসিল বলার কারণ কোটি বছর ধরে এ প্রজাতির টিকে থাকা। এরা পৃথিবীতে সাড়ে ১২ কোটি (১২৫ মিলিয়ন) বছর ধরে নিজের বংশকে অবিকল টিকিয়ে রেখেছে! হাল্কা গোলাপি এই সার্কটি লম্বায় সচরাচর ১০ থেকে ১৩ ফুটের হয়ে থাকে।
ফ্রিলড সার্ক : Frilled shark
প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরে পাওয়া এ মাছের বসবাস সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫০ থেকে ১৫৭০ মিটার (১৬০ থেকে ৫১৫০ ফুট) গভীরে। অন্যান্য বহু হাঙরের মতো এটিও যেন জ্যান্ত ফসিল! আসলে হাঙরের গোটা জাতটাই খুব প্রাচীন। প্রচলিত হাঙরদের চাইতে এদের শরীর অনেক সর্পিল। মানে এঁকেবেঁকে চলার মতো। চেহারা ভুতুড়ে আর বেরিয়ে থাকা ক্ষুরধার দাঁতগুলো ভেতরের দিকে বেঁকে গিয়ে একে করেছে আরও ভয়ানক! যাতে একবার শিকার পড়লে আঙটার মতো আটকে যায়! এরা ৬ ফুটের বেশি লম্বা হয়।
প্যাসিফিক ভাইপার মাছ ঃ Pacific viperfish
মাত্র আট ইঞ্চি গড় দৈর্ঘ্যরে এই প্রাণীটি দেখতে ছোট হলেও সাঙ্ঘাতিক রকমের বীভৎস। সরু দেহের তুলনায় বড়সড় মাথা, ঠিকরে বের হয়ে আসার মতো চোখ আর অস্বাভাবিকরকম বড় বড় কাঁটার মতো দাঁত এদের দিয়েছে ভয়ঙ্কর চেহারা। ভাইপার ফিশের এ প্রজাতির আবাস প্রশান্ত মহাসাগরের ২০০ থেকে ৫০০০ মিটার গভীরে! অর্থাৎ একেবারে হিম অন্ধকার জগতের বাসিন্দা এরা।
জীবন্ত জীবাশ্ম সিলাকান্থ
একপ্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ যাদের ‘জীবিত জীবাশ্ম’ বলা হয়। ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় এই মাছটি দেখা যায়। এর দুটি প্রজাতির একটি আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কমোরোজ দ্বীপপুঞ্জের কাছে এবং অপরটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব উপকূলে। ফসিল প্রমাণ অনুসারে এটি বিলুপ্ত মনে করা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার চালুমনা নদীর মোহনায় স্থানীয় জাদু ঘরের কিউরেটর মিস ল্যাটিমার জীবিত সিলাকান্থ পুনরাবিষ্কার করেন। ৪০ কোটি বছর আগে এ মাছ পৃথিবীতে ছিল। প্রথম দেখা যায় ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়।
ভুতুড়ে হাঙর : Ghost Shark
হাঙরের আরও একটা অদ্ভুত প্রজাতি হলো এই সুচালোমুখো ভুতুড়ে হাঙর। এদের কুতকুতে চোখ আর অদ্ভুত কারুকার্যের মাথা দেখলে মনে হবে যেন অন্যরকম কোনো কিছু! প্রশান্ত ও দক্ষিণ মহাসাগর, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসহ বিশ্বের অনেক জায়গাতেই সমুদ্রের ৬১০ থেকে ২০০০ মিটার (২০০০-৬৫৬০ ফুট) গভীরে এদের দেখা মেলে।
ব্ল্যাক স্যালোয়ার
এটি এমনই এক মাছ, যে তার শরীরের চাইতেও বড় কিছুকে গিলে ফেলতে সক্ষম! সমুদ্রপৃষ্ঠের ৭০০ থেকে ২৭৪৫ মিটার (২২৯৭-৯০০৬ ফুট) নিচে বসবাস করা এই প্রাণীদের দৈর্ঘ্য সবে ৯.৮ ইঞ্চি। অথচ এরা নিজ ভরের চাইতে দশগুণ বেশি ভরের আর কয়েকগুণ বড়/লম্বা প্রাণীকে গিলে ফেলতে সক্ষম। এদের চোয়ালের গঠনের ফলে এদের মুখে ঢুকে পড়া সরু কোনো প্রাণী সহজেই আটকে দাঁতগুলোর ভেতরমুখী ধাক্কায় ভেতর দিকে চলে যায়। ২০০৭ সালে কেইমেন দ্বীপের উপকূলে পাওয়া ৭.৫ ইঞ্চির এক স্যালোয়ারের পেট থেকে একটি মাছ পাওয়া যায় যার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৪ ইঞ্চি! মানে নিজ দেহের চাইতেই প্রায় সাড়ে চারগুণ লম্বা! এ মাছ বিশ্বজুড়ে গভীর সমুদ্রের সর্বত্রই দেখা যায়।
ফ্যাংটুথ ফিশ: Fangtooth Fish
এদের মুখটা অনেকটা ভাইপার ফিশের মতো দেখতে হলেও এরা আকারে ভাইপার ফিশের অর্ধেক, অর্থাৎ ৬ ইঞ্চির মতো আর আকৃতিতেও ভিন্ন। ফ্যাংটুথের দাঁত শরীরের অনুপাতে সমুদ্রের অন্য যেকোনো মাছের চাইতে বড়। তবে এত বীভৎস দর্শন হলেও এরা মানুষের ক্ষতি করার মতো নয়। এরা খুবই গভীর জলের মাছ। এদের আবাসস্থলের গভীরতা ২০০০ থেকে ৫০০০ মিটার (৬৫০০-১৬৫০০ ফুট)। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত এদের দুটো প্রজাতি রয়েছে।
Fangtooth Fish |
সি কিউকাম্বার : Sea Cucumber
নামটা ‘সামুদ্রিক শসা’ হলেও এটিও এক ধরনের মাছ। এই প্রজাতিটা অত্যন্ত গভীর জলের প্রাণী, যাদের দেখা পাওয়া যায় প্রায় ৩২০০ মিটার বা ১০৫০০ ফুট গভীর জলে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এই অসম্ভব সুন্দর অদ্ভুত প্রাণীটা যে গভীরতায় বসবাস করে সেখানে সূর্যের আলো না পৌঁছানোর ফলে সেখানকার পানি প্রচণ্ডরকমের ঠান্ডা থাকে। তবু সেখানে দিব্যি এদের বসবাস। এরা গোলাপি ও কালো রঙের হয়।
Sea cucumber |
Sea cucumber |
জায়ান্ট আইসোপড : Giant Isopod
বিশালাকৃতির এই পোকার সাইজ আর আবাসস্থল জানলে সত্যিই অবাক হতে হয়। মেক্সিকো অঞ্চলে বসবাসকারী এই আইসোপড পোকারা সমুদ্রপৃষ্ঠের এক কিলোমিটারের নিচেও বসবাস করে যার গভীরতা প্রায় ৩৫০০ ফুট। আর আকারে এরা ১৪ ইঞ্চি পর্যন্তও হয়। বিশাল তেলাপোকা সদৃশ এই ভয়ানক প্রাণীরা মূলত মৃতভোজী।
গভীর জলের এই মাছদের অনেক প্রজাতি আছে। তবে এদের মাঝে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো স্বচ্ছ মাথা ব্যারিলিয়ি। এই মাছটির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো এদের মাথার দিকটা অস্বাভাবিকরকমের স্বচ্ছ। যার ফলে মাথার ভেতরটা তো দেখা যায়ই, সঙ্গে বেলুনাকৃতির চোখ দুটোও দেখা যায়। হুট করে দেখলে মনে হবে বুঝি কোনো খেলনা বা রোবট মাছ বা ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে উঠে আসা কিছু! এরা সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে এদের বসবাস। ১৯৩৯ সালে এই প্রজাতিটা আবিষ্কৃত হলেও ক্যামেরার চোখে প্রথম জ্যান্ত ধরা পড়ে ২০০৪ সালে।
অবশ্যই আমাদের এই পোস্টটি আপনার বন্ধুদের
মাঝে সেয়ার করে ছড়িয়ে দিন।