আপনার চোখের সামনে কেউ হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল, এর কারণ হতে পারে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা অন্য কোনো অসুস্থতা। যদি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় তাহলে সে আপনার চোখের সামনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যাবে। তবে আপনি যদি কিছু ফাস্টএইড জানেন তাহলে হয়তো আপনি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন, হাসপাতালে নেয়া পর্যন্ত।
প্রথমে বুঝি নেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে নাকি অন্যকিছু:-
আমাদের হার্টে একটি ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম আছে, যার কারণে হার্ড সবসময় করতে থাকে। আর সারা শরীরে রক্ত চলাচল করতে থাকে। যখন ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম এ কোনো গুরুতর সমস্যার ফলে শরীরের রক্ত চলাচল করা বন্ধ করে দেয়, তখন সেটাকে বলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার কমন কারণ হলো হার্ট অ্যাটাকে, হার্টে বংশগত সমস্যা ইত্যাদি। একটা উদাহরন দিয়ে এখন সামনে আগায়, আপনার সামনে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে আপনার কলিগ সালমান। সে বংশগতভাবে হার্টের একটা সমস্যা নিয়ে জন্মেছে কিন্তু সেটা সে জানত না। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি হঠাৎ করে আজকে সেই বংশগত সমস্যার কারণে তার হার্টের ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমে গোলমাল তৈরি হলো। নানা জায়গায় ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম ফায়ার করছে। ফলে তার হার্ট স্বাভাবিকভাবে সংকোচন-প্রসারণ না হয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। এমন কাপলে শরীরে তো আর রক্ত চলাচল করতে পারে না। ফলে ব্রেইনের রক্ত যাচ্ছেনা। শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়ে এসেছে, সালমান অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। পড়ে গেছে এটা তার মনে থাকবে না কারণ তার ব্রেনে অক্সিজেন যাচ্ছে না। ফলে তার ব্রেনে কিছু কোস মারা যেতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় আপনার কাজ শুরু।
তাকে বাঁচানোর জন্য ওর হার্টের কাজটা আপনি নিজের হাতে তুলে নিবেন। সালমানের বুকের জোরে জোরে চাপ দিয়ে ব্রেনে রক্ত চলাচল করাবেন। যাতে ওর ব্রেন ভালো থাকে, অনেকখানি মোরে না যায়। আপনি এই কাজটা করলে সালমানের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে দুই থেকে তিনগুণ, এটাকে বলে Cardiopulmonary Resuscitation বা CPR। CPR কিভাবে করবেন বঝাচ্ছি। যখন দেখলেন সালমান পড়ে গেল, তখন আপনাকে খুব দ্রুত তিনটা কাজ করতে হবে।
১.জ্ঞান আছে কিনা চেক করুন:- হালকা করে ঝাঁকি দিয়ে জোরে আওয়াজ করে জিজ্ঞেস করবেন সালমান তুমি কি ঠিক আছো? সালমান কোনো সাড়া দিল না নড়াচড়া করল না অর্থাৎ সে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
২.সাহায্যের জন্য অন্যদের থাকুন:- এখন আপনার সাথে আরো কয়েকজন মানুষ লাগবে। তাই চিৎকার করে আশেপাশের মানুষকে থাকুন, তাদেরকে বলুন 9999 নাম্বারে কল দিতে এবং Defibrillator নামের যন্ত্রটি নিয়ে আসতে। এটিকে অনেকেই নামে চিনে যাদের সাথে এই কাজগুলো করতে বলবেন যদি আশা পাশে কেউ না থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি মোবাইলে 999 আপনি যে অঞ্চলে আছেন সেই অঞ্চলের জরুরী সেবা নাম্বারে কল দিয়ে স্পিকার অন করে ফোনটা পাশে রাখুন।
৩.শ্বাস-প্রশ্বাস চেক করুন:- ১ ও ২ নাম্বার কাজ করার সাথে সাথে খেয়াল করেন সালমানের শ্বাস- প্রশ্বাস কেমন স্বাভাবিক ওঠানামা করছে বাতাস আসা-যাওয়া করছে সবার শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না করে শ্বাস প্রশ্বাস কেমন হতে পারে দেখিয়ে দিচ্ছি।
যদি সালমান আপনার কথায় কোনো সাড়া না দেয় আর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক না হয়, বন্ধ হতে হবে এমন কথা নেই তাহলে ধরে নিবেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাই এক্ষুনি CPR শুরু করতে হবে। ধরেন আপনি বুঝতে পারছেন না শ্বাস স্বাভাবিক নাকি মনে হচ্ছে শ্বাস আছে কিন্তু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক সেটা বুঝতে পারছেন না। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কিনার সিওর না তাও আপনি CPR শুরু করবেন। অনেকে ভয় পায় যদি ভুলে CPR শুরু করি যখন আসলে CPR দরকার ছিল না তাহলে কি আপনার অনেক বড় ক্ষতি হবে। উত্তর হলো না না এবং না। বুকে চাপ দিলে সালমান এর ক্ষতি হবে এমন কোনো দুশ্চিন্তা আপনার করার দরকার নাই। আপনি বুকে চাপ দেয়া শুরু করবেন ও সুস্থ থাকলে নিজেই আপনাকে সরিয়ে দিবে। সব গাইডলাইনেই American Heart Association , British Heart Foundation, Resuscitation Council UK - দুশ্চিন্তা না করে CPR দেওয়া শুরু করতে বলে। যদি সালমানের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে থাকে আপনি কিছু না করলে কয়েক মিনিটেই সে মারা যাবে, তাই সালমানের কোন ক্ষতি হবে এমন ভয় বাদ দিয়ে আপনি CPR শুরু করবেন যত দ্রুত পারেন।
CPR দেওয়ার নিয়ম:- এখন CPR দেওয়ার নিয়মটা বলি-- তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন, বুকের ঠিক মাঝখানে এক হাতের তালুর নিচে রাখবেন আর হাতের তালু তার ওপরে বসাবেন, তারপর আঙুলগুলো একটার ভিতর একটা ঢুকাবেন এমন করে, তারপর তার বুকের ওপর ঝুঁকে আসবেন যাতে আপনার মাথা আর হাতের তালু একটা সোজা লাইন বরাবর থাকে। এভাবে রাখলে আপনি ঠিকমতো চাপ দিতে পারবেন। তারপর সালমানের বুকে চাপ দেবেন যাতে অন্তত ৫ সেন্টিমিটার দেবে যায়। ৫ সেন্টিমিটার কিন্তু অনেক টুকু। বুঝতেই পারছেন বেশ জোরে চাপ দিতে হয় এবং খুব দ্রুত করতে হয়। প্রতি মিনিটে 100 থেকে 120 বার অর্থাৎ 1 সেকেন্ডে প্রায় দুই বার চাপ দিতে হয়। এই কাজটা সালমানের জীবন বাঁচাতে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বুকে চাপ দিয়ে দিয়ে সালমানের ভিডিও হার্টি আপনি রক্ত পাঠাচ্ছেন। দুইটা চাপ দেয়ার মাঝখানে সময় খেয়াল রাখবেন সালমানের বুক আবার পুরোপুরি আগের অবস্থানে ফিরে আসে এতে রক্ত চলাচল করবে। সারাক্ষণ বুকে চাপ দিয়ে রাখবেন না, এক চাপ দিয়ে তারপর হালকা করে ছেড়ে দেবে, 2 চাপের মাঝখানে বুকের ওপরে ভর দিবেন না। একজন মানুষ সাধারণত দুই মিনিটের বেশি ভালোভাবে বুকে চাপ দিতে পারেনা। তাই দুই মিনিট পরপর বা তার আগেও যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বা মনে হয় যে 5 সেন্টিমিটার দাবাতে পারছে না তাহলে আরেকজন তার জায়গা পরিবর্তন করতে পারেন। যেত সবচেয়ে কম সময় নষ্ট হয় সেই চেষ্টা করবেন। ৩০ বার বুকে চাপ দেয়ার পর দুইটা রেসকিউ ব্রিথ দিতে হয়। তারপর আবার 30 বার বুকে চাপ ও ২টা রেসকিউ ব্রিথ এভাবে চালিয়ে যেতে হয়।
রেস্কিউ ব্রিথ দেওয়ার নিয়ম:- রেস্কিউ ব্রিথ কিভাবে দিতে হয়-- এক হাত দিয়ে রোগীর মাথা হালকা নিচু করে আরেক হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে থুতনি উচু করে যেই হাত মাথায় সেটার আঙ্গুল দিয়ে রোগীর নাক বন্ধ করে তার মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে একটা সেকেন্ড দিয়ে শ্বাস ছেড়ে রোগীর ফুসফুসে বাতাস ঢোকানোর চেষ্টা করতে হয়। তবে অনেকেই এটি দিতে পারেন না বা এটি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তখন এটার দরকার নাই না পারার কারণে দয়াকরে CPR থেকে বিরত থাকবেন।
ডিফিব্রিলেটরের ব্যবহার:-
এটাকে অনেকে AED বা PED বলে। এটার মাধ্যমে রোগীকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। ওই যে হার্ট সুদু কাঁপছে, পাম্প করতে পারছেনা ইলেকট্রিক শক দিয়ে হার্টের এলোমেলো কাপাকাপি মুহূর্তের জন্য বন্ধ করা হয়। হার্ট যদি তখনো ভালো থাকে, হার্ট ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম আবার স্বাভাবিক ভাবে বিট করার শুরু করতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে পাবলিক প্লেসে যেমন শপিংমলে, হোটেলে, স্কুলে এই যন্ত্র বিভিন্ন জায়গায় রেখে দেয়া হয়। যাতে করে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। এগুলো যে কেউ ব্যবহার করতে পারে পাবলিক প্লেসে যেসব ডিপেব্লটার থাকে সেগুলোই ধাপে ধাপে বলে দেয় কোন টার পরে কি করতে হবে। রোগীর প্রয়োজন না হলে ইলেকট্রিক শক দেয় না, তাই এখানেও রোগীর ক্ষতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই বরং বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের দেশে পাবলিক প্লেসে সাধারণত এই যন্ত্র থাকে না। আপনারা যারা এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, আপনার অফিসের জন্য, বিল্ডিং, সোসাইটি, স্কুলের জন্য, কয়েকজন মিলে একটি ডিপেব্লটার কিনা সেটা কিভাবে চালাতে হয় শিখে নিতে পারেন। হাতের কাছে থাকলে সেটা ব্যবহার করবেন আর না থাকলে CPR চালাতে থাকবেন। কারণ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে কখনো কখনো ডিপেব্লটার ব্যবহার করার দরকার হয় না, CPR ই যথেষ্ট।
কতক্ষন CPR চালিয়ে যাবেন:-
যতক্ষণ না জরুরি সেবা থেকে সাহায্য আসে বা সালমানের জ্ঞান ফিরে আসে। হয়তো সালমান কাশি দিচ্ছে, কথা বলছে বা শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর এই সবকিছুর আগে খুব তাড়াতাড়ি দেখে নিবেন জায়গাটা আপনার জন্য নিরাপদ কিনা, রাস্তার মাঝখানে কেউ হঠাৎ করে অজ্ঞান হলে আপনি কিছু না দেখে সেখানে ছুটে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, তারপরে আগাবেন। তাহলে সিখে গেলেন এই পরিস্থিতিতে আপনার কি কি করা উচিত। আবারও মনে করিয়ে দিয়:-
নিরাপদ কিনা দেখে নিন:-
1. কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দেখুন জ্ঞান আছে কিনা
2. সাহায্য ডাকুন
3. শ্বাসপ্রশ্বাস দেখুন
4. দ্রুত CPR শুরু করুন
5. সম্ভব হলে Rescue Breath দিন
6. Defibrillator ব্যবহার করুন
আশা করছি আপনাদের কখনোই এই বিপদে পড়তে না হয়। যদি বিপদ আসেও এখন আপনি জানেন কি করতে হবে। ততটুকু মনে থাকে ততটুকু দিয়ে চেষ্টা করবেন, আপনার চেষ্টাতে হয়তো একটা জীবন বেঁচে যাবে আর না হলেও আপনি জানবেন আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা টুকু আপনি করেছিলেন।
ধন্যবাদ..
লেখাঃ- সুইট কিরণ মণ্ডল
মুর্শিদাবাদ